মো: তোফাজ্জল বিন আমীন:
দুর্ঘটনার মৃত্যু যেখানে মেনে নিতে কষ্ট হয়, সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুর ঘটনা কত যে কষ্টের ভুক্তভোগী পরিবার ছাড়া কেউ অনুধাবন করতে পারেন না। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা, সিলেট ও বাগেরহাটে পুলিশ হেফাজতে চারটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। হেফাজতে মৃত্যুর এসব ঘটনা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে। পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা নতুন নয়! আগেও অনেকের জীবন গেছে। সিলেটের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে পুলিশ হেফাজতে রায়হান আহমদ নামের এক যুবকের মৃত্যুর রেশ কাটতে না কাটতে ঢাকার নবাবগঞ্জ থানা হাজতের টয়লেট থেকে এক আসামির ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অর্জিত সুনাম প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এসব ঘটনায় বাহিনীর কিছু অসৎ সদস্য জড়িত হলেও তাদের কারণে পুরো পুলিশ বাহিনীর ভাবমর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। অথচ করোনাকালে পুলিশ বাহিনীর মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেশবাসীর সামনে এখনো জ্বল জ্বল করছে।
১৯৪৭ সালের আগে ব্রিটিশ, ১৯৭১ সালের আগে পাকিস্তানি পুলিশ বাহিনী আমাদের ওপর জুলুম নির্যাতন করেছে। সেসব নির্যাতনের কাহিনী মনে হলে আজো গা শিউরে ওঠে। বর্তমানে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে যারা কাজ করছেন, তারা ব্রিটিশও নন; পাকিস্তানিও নন; আমাদের কারো ভাই, কারো ছেলে, কারো স্বজন। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে প্রাণ হারানো রায়হান আহমদের পরিবার কিংবা স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব কেউ না কেউ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে চাকরি করছেন। তা হলে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে রায়হানদের প্রাণ এভাবে দিতে হবে কেন? পুলিশের দায়িত্ব নাগরিকের অধিকার রক্ষা করা, বিপন্ন করা নয়; কিন্তু পুলিশ বাহিনীর বহু ভাগ সদস্য প্রমাণে ব্যস্ত তারা সরকারের কত কাছের। ফলে তারা রাষ্ট্রের নয়, সরকারের হাতিয়ার হয়ে উঠছে। গেল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুলিশের ভূমিকা কতটুকু স্বচ্ছ ছিল তা কারো অজানা নয়! ক্ষমতাসীন দল পুুলিশকে ব্যবহার করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়েছে ঠিকই, কিন্তু রাষ্ট্রীয় এ বাহিনী বিতর্কিত হয়েছে। এ বিতর্কের অবসান তাদেরই করতে হবে। নতুবা এ বাহিনীতে বিতর্কিত কর্মকাণ্ড বাড়তেই থাকবে।
পুলিশ কাউকে হত্যা করে যদি বলে তিন ডাকাত বা জঙ্গি, তবে তাতে তার অপরাধ প্রমাণিত হয় না। পুলিশের ছত্রছায়ায় থেকে গুণ্ডামি, মাস্তানি, চাঁদাবাজি করলেও তাদের গ্রেফতার করা হয় না, এমন নজির রয়েছে ভুরি ভুরি। অথচ ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীকে নিপীড়নে উৎসাহী ভূমিকা পালন করতে পুলিশ পিছপা হয় না।
১৯৯৮ সালে পুলিশি হেফাজতে শামীম রেজা রুবেল নিহত হওয়ার পর মানবাধিকার সংস্থা ব্লাস্টের পক্ষে রিমান্ডে নির্যাতনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একটি রিট দায়ের করা হয়েছিল। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ১৫ দফার একটি নির্দেশনা দিয়েছিল। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারা অভ্যন্তরে স্বচ্ছ কাচ নির্মিত বিশেষ কক্ষে আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে, যাতে বাইরে থেকে তার আইনজীবী দেখতে পারেন, তার মক্কেলকে নির্যাতন করা হচ্ছে না। পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন হলে তা ম্যাজিস্ট্রেটের নজরে এলেই মেডিক্যাল বোর্ড গঠনের নির্দেশ দেবেন। কিন্তু এসবের কিছুই মানা হচ্ছে না। বরং উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে রিমান্ডের নামে নিষ্ঠুরতা চলছে, এমন অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মেনে চললে এবং ফৌজদারি কার্যবিধির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী আদায়সংক্রান্ত ধারা ১৬৪ ও ৩৬৪-কে সময়োপযোগী করে কিছুটা পরিবর্তন করলে মামলার তদন্ত আরো স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য হতো। এ ছাড়াও রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ এবং ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী আদায়ের সময় আইনজীবীর উপস্থিতি ও অডিও এবং ভিডিও রেকর্ডিং নিশ্চিত করতে পারলে নির্যাতনের মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব বলে আইন অঙ্গনের সাথে সম্পৃক্তদের অভিমত।
১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ২৫, ২৬ ধারাতে বলা হয়েছে, পুলিশের হেফাজতে থাকাকালীন দোষ স্বীকার গ্রহণযোগ্য হবে না। একজন আসামিকে যখন পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, তখন সুস্থ স্বাভাবিক থাকেন। কিন্তু পুলিশ হেফাজত থেকে আদালতে উপস্থিত করার সময় দেখা যায়, তিনি আর হাঁটতে পারছেন না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত।
বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যানুযায়ী, গত ২০ মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছেন ২৮ জন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে গ্রেফতারের আগে ও পরে ১২ আসামির মৃত্যু হয়েছে। ২০১৯ সালে হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৬ জন। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চার বছরে ২৬০ জন হেফাজতে মারা গেছেন, ২০১৬ সালে এক বছরেই মারা গেছেন ৭৮ জন।
গ্রেফতার করা আসামিকে থানা হাজতে রাখলে কী নিয়ম পালন করতে হবে, সে বিষয়েও আইনের দিকনির্দেশনা রয়েছে। যেমন : আসামিকে থানা হাজতে রাখার আগে তার দেহে কোনো জখম থাকলে দু’জন নিরপেক্ষ সাক্ষীকে দেখাতে হবে এবং সাধারণ ডায়েরিতে বিষয়টি লিপিবদ্ধ করতে হবে। (পিআরবি ৩২৮(খ) বিধি,পুলিশ আইনের ৪৪ ধারা।
আসামি অসুস্থ হলে বা গায়ে জখম থাকলে থানায় ডাক্তার ডেকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করতে হবে (পিআরবি ৩২১ বিধি। ডিএমপি অধ্যাদেশ ১৬ ধারা)। আসামিকে থানা হাজতে কোনো প্রকার নির্যাতন করা যাবে না। পুলিশ আইনের ২৯(৭) ধারা, দণ্ডবিধির ৩৩১ ধারা। কোনো থানা বা ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত অফিসার ওই থানায় বা ফাঁড়িতে আনা সব বন্দীর নিরাপত্তা জিম্মার জন্য দায়ী থাকেন (পিআরবি ৩২৫(ক) বিধি)।
যে পুলিশ বাহিনী জনগণের নিরাপত্তা দেয়ার স্বার্থে নিয়োজিত, সেই তাদের হেফাজতে কেন মানুষের মৃত্যু হবে, বিষয়টি রাষ্ট্রের খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
Leave a Reply